টাচ স্ক্রিন কীভাবে কাজ করে?

 টাচ স্ক্রিন কীভাবে কাজ করে?


টাচ স্ক্রিনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৯৬৫ সালে ইংল্যান্ডে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এর জন্য প্রথম টাচ স্ক্রিন তৈরী করা হয়, এবং ১৯৭৫ সালে কম্পিউটারে টাচ স্ক্রিন তৈরী করা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো এটি তখনও মানুষের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য না হওয়ায়, তখনকার বাজার কি-বোর্ড ও মাউস দখল করে নেয়। ৯০ দশকের পর কম্পিউটারের এক রেভ্যুলেশন ঘটে যেখানে টাচ স্ক্রিনের ব্যবহারের নতুন দিক উঠে আসে। বর্তমানের প্রায় সকল স্মার্টফোন, ইবুক রিডার, এমপি থ্রী প্লেয়ার, ল্যাপটপেও এই টাচ স্ক্রিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে প্রশ্ন আসে টাচ স্ক্রিন ব্যবহারে আসলে কতটা সহজ এবং এটা কীভাবে কাজ করে?
একটি টাচস্ক্রিনকে একটি অদৃশ্য কি-বোর্ড এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটা কীভাবে কাজ করে তা জানার জন্য আগে সাধারণ কিবোর্ড কীভাবে কাজ করে তার সম্পর্কে জ্ঞান থাকা দরকার। কি-বোর্ড এর প্রতিটা কি হলো একটি ইলেক্ট্রনিক সুইচ। যখনই এটা প্রেস করা হয় তখন একটি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট পুর্ণ হয় এবং কারেন্ট প্রবাহিত হয়। কারেন্ট নির্ভর করে কোন কি -তে প্রেস করা হচ্ছে এবং এভাবে কম্পিউটার বুঝে নেই যে কী লিখা হচ্ছে। একটু বিস্তারিত বললে বিষয়টা এমন যে, একটি কি-বোর্ড এর মধ্যে দুই লেয়ারের বৈদ্যুতিক পরিচালন এ সক্ষম প্লাস্টিক থাকে যার মাঝে একটি অন্তরক প্লাস্টিক থাকে এবং এর মধ্যে একটি ফুটো থাকে। প্রতিটা কি -তেই অন্তরকের মধ্যে এমন ফুটো থাকে। যখন একটি কী প্রেস করা হয় উপরের পরিবাহী, নিচের পরিবাহীর সাথে সেই অন্তরকে থাকা ফুটোর মাধ্যমে পরস্পরকে স্পর্শ করে। তখন একটি কারেন্ট ফ্লো হয় যার মাধ্যমে কম্পিউটার জানতে পারে কোন কি প্রেস করা হয়েছে। আর ছোট্ট একটি স্প্রিং ব্যবহার করা হয় কি তে যেন প্রেস করার পর আবার আগের স্থানে ফিরে আসে এবং সার্কিট ব্রেক করিয়ে দেই। টাচস্ক্রিনও প্রায় একই ধরণের। এটা ঠিক যে এখানে সুইচ ব্যবহার করা হয় না যা স্ক্রিনকে ব্লক করে দিবে।
তবে কীভাবে টাচ করার পরও অদৃশ্যভাবে এটা বুঝে ফেলে!!
কীভাবে টাচ স্ক্রিন কাজ করে?
বিভিন্ন ধরণের টাচস্ক্রিন বিভিন্ন ভাবে কাজ করে। কিছু স্ক্রিন শুধু একটি আঙ্গুলের এর অবস্থান বুঝতে পারে এবং দুই আঙ্গুল ব্যবহার করলে সার্কিট কনফিউজড হয়ে যায়, নির্দিষ্ট কোন অংশ প্রেস করা হচ্ছে তা নির্ধারণ করতে। বাকিগুলোতে সহজে একটার বেশি আঙ্গুল ধরতে ও নির্ণয় করতে পারে। নিচে কিছু অধিক প্রচলিত টেকনোলজি নিয়ে আলোচনা করা হলো :- রেজিজটিভ (Resistive)
রেজিজটিভ টাচস্ক্রিন যা বর্তমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রযুক্তি। এই টাচস্ক্রিন কাজ করে কিছুটা "স্বচ্ছ কি-বোর্ড" এর মতো, যা স্ক্রিন এর উপর আবৃত থাকে। সেখানে উপরে একটি নমনীয় বৈদ্যুতিক পরিচলনা সক্ষম পলিস্টার প্লাস্টিকের স্তর থাকে, যা নিচের স্তরের একটি অনমনীয় পরিচলনা সক্ষম গ্লাসের সাথে যুক্ত থাকে, একটি অন্তরক মেমব্রেন এর সাথে। যখনই স্ক্রিন এ প্রেস করা হয় তখন পলিস্টারের স্তর গ্লাসের স্তরের সাথে যুক্ত হয় এবং কি-বোর্ড এর প্রেস করার মতো একটি সার্কিট পুর্ণ করে। আর স্ক্রিন এ থাকা একটি চিপ স্হানাঙ্ক নির্ণয় করে কোথাই প্রেস করা হয়েছে সে জায়গার।
ক্যাপাসিটিভ (capacitive)
এই স্ক্রিনগুলো কয়েক স্তরের গ্লাস দিয়ে তৈরী হয়। ভিতরের স্তরগুলোতে বিদ্যুৎ পরিচলনা করে এবং বাহিরের স্তরেও যেন স্ক্রিন কার্যকরভাবে কাজ করে যেমনটা দুইটা বৈদ্যুতিক পরিবাহি একটি অন্তরক দ্বারা পৃথক হয়ে থাকে অন্য ভাষাই ক্যাপাসিটর।।যখনই স্ক্রিনের উপর আঙ্গুল রাখা হবে তখন বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হয় যা আঙ্গুল কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে। ক্যাপাসিটিভ স্ক্রিনে একটার বেশি আঙ্গুলের টাচ কাজ করে। এটা অন্য টাচস্ক্রিনের মতো নয় কারণ প্লাস্টিকের কোনো স্তর থাকলে স্ক্রিন রেসপন্স করে না।
ইনফ্রারেড (Infrared)
ইনফ্রারেড টাচস্ক্রিনে মূলত ব্যবহার করা হয় এলইডি এর প্যাটার্ন এবং লাইট ডিটেক্টর ফটোসেল যা স্ক্রিন এর বিপরীত দিকেও থাকে। এলইডিগুলো থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি স্ক্রিনের সামনে জ্বলজ্বল করে যা দেখতে কিছুটা অদৃশ্য মাকড়সার জালের মতো। স্ক্রিমের কোথাও টাচ করা হলে দুই বা ততোধিক আলোকরশ্মি বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্ক্রিনে থাকা একটি মাইক্রেচিপ আঙ্গুলের স্পর্শ কোথায় পরেছে যার জন্য আলো চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে তা নির্ণয় করে। সনি ইবুক রিডার এ এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
(Surface Acoustic Wave)
আশ্চর্যজনকভাবে এই টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি আলোর পরিবর্তে শব্দের দ্বারাই আঙ্গুল সনাক্ত করতে পারে। আল্ট্রাসনিক শব্দ তরঙ্গ (মানুষের শ্রবণ শক্তির বাহিরে) স্ক্রিনের প্রান্ত থেকে বের হয় এবং প্রতিফলন হয়ে ফিরে আসে এবং এর পৃষ্ঠতল জুড়ে প্রতিফলিত হয়। যখন স্ক্রিনে টাচ করা হয় তখন আঙ্গুলের দ্বারা শব্দ তরঙ্গ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং কিছু শক্তি ক্ষয় হয়। তখনই স্ক্রিনে থাকা মাইক্রোচিপ কন্ট্রোলার নির্ণয় করে সঠিক কোন বিন্দুতে স্পর্শ করা হয়েছে।
(Near Field Imaging)
তীব্র শব্দ উৎসের কাছে থাকলে দেখা যায় তা শরীরের উপর প্রভাব পড়ছে। আমাদের শরীর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয় যা উৎসের থেকে আসে। যদি কাছাকাছি যাওয়া হয় তবে এটি শরীরের উপর আরও বেশি প্রভাব ফেলে। নেয়ার ফিল্ড ইমেজিং (NFI) এই একই ভাবে কাজ করে। যখন স্কিনের টাচ করা হয় তা স্ক্রিনের ইলেকট্রিক ফিল্ডকে পরিবর্তন করে যা দ্রুত টাচ করা জায়গা চিহ্নিত করতে পারে। এটি অন্য প্রযুক্তি থেকে অনেক শক্তিশালী এবং যেকোনো খারাপ পরিবেশে কাজ করে। NFI কলম, গ্লাভবস সহ জিনিসগুলো সনাক্ত করে পারে। এই প্রযুক্তি মূলত সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
টাচ স্ক্রিনের সুবিধা।
টাচ স্ক্রিন টেকনোলজির সবচেয়ে বড়ো সুবিধার জিনিস হলো এটি মানুষ সহজে খুব সহজে ব্যবহার করতে পারে। টাচস্ক্রিন মানুষের যতটুকু তথ্যের দরকার হয় তার সবটুকু প্রদর্শন করতে পারে এবং যেকোনো কাজ করতে জটিল প্রসেসে না গিয়ে খুবই সহজ এবং সিস্টেমিক উপায়ে করা যায়। এজন্যই প্রায় সর্বক্ষেত্রে এর ব্যবহারের প্রচলন চলছে। কারণ সাধারন কম্পিউটারের স্ক্রিন ও কি-বোর্ডেও অনেক সময় সময় সমস্যা হয়।
বর্তমানে বেশিভাগ মানুষ অ্যাপল বা অন্ড্রোয়েড স্মার্টফোন ব্যবহার করে যেগুলোতে মাল্টিটাচ স্ক্রিন থাকে। টাচ স্ক্রিনের বড় সুবিধা হলো এই টাচ স্ক্রিন তাই দেখায়, যেটা করার চেষ্টা করা হয়। যখন ফোন কল করা হয় তখন ডিসপ্লেতে শুধু ০-৯ পর্যন্ত নম্বরের জন্য কাজ করে। আর ম্যাসেজ টেক্সট করার সময় এটি কিবোর্ড এর জন্য কাজ করে। আবার গেম খেলার সময় এর অবস্থা আবার পরিবর্তিত হয়। টাচ স্ক্রিনগুলো বহুমুখি কাজে ব্যবহার করা যায়, প্রতি মুহুর্তে পরিবর্তন হয় প্রয়োজন অনুসারে। আরেকটা বড়ো সুবিধা হলো এতে কোনো মুভিং পার্ট নেই। সাধারণ কম্পিউটারে কি-বোর্ড এ যেমন শতাধিক পার্টস থাকে, সার্কিট থাকে, তাই সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। স্মার্টফোন, ইবুক রিডার এবং ট্যাবলেটে এটি দেখা গেলেও পিসি ও ল্যাপটপে অনেকটা আনকমন। তবে মাইক্রোসফট তাদের আপডেট রেখেছে অপারেটিং সিস্টেম এ টাচ অপশন ও ভার্চুয়াল কি-বোর্ড অপশন রেখেছে। সময়ের সাথে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হচ্ছে, যার কারণে প্রচলিত ৬০ হার্জের টাচ রেসপন্সের বাহিরে ১২০/১৪৪/২৪০/২৭০ হার্জ পর্যন্ত ব্যবহার করা হচ্ছে যা অন্তত ফাস্ট ও স্মুথ এক্সপেরিয়েন্স দেয়। সময়ের সাথে এই প্রযুক্তির আরও উন্নত সংস্করণ আসছে যা ভবিষ্যতের জন্য অন্তত কার্যকরী পদ্ধতি।

কোন মন্তব্য নেই

Goldmund থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.