কিভাবে মানুষের মস্তিষ্ক দ্বারা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস।
কিভাবে মানুষের মস্তিষ্ক দ্বারা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস।
মডার্ন কম্পিউটার গুলো দিনদিন যতোবেশি উন্নত হচ্ছে তার পাশাপাশি এরা মানুষের ব্রেইনকেও ততোবেশি বোঝার চেষ্টা করছে। আর এর ফলেই আমাদের কল্পনার সায়েন্স ফিকশন গুলোকে আমরা একে একে ব্যস্তবে পরিণত করতে পারছি। এই আর্টিকেলে, বিসিআই কিভাবে কাজ করে জানবো এবং এই প্রযুক্তির সম্ভবনা নিয়ে আলোচনা করবো, তো শুরু করা যাক…
ব্রেইনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল।
মানুষের ব্রেইন এবং কম্পিউটারের সাথে আমরা কেন তুলনা করি এবং কেনই বা দুইটিকে একসাথে কানেক্ট করতে চাই? দেখুন কম্পিউটার হলো প্ল্যাস্টিক, ট্র্যানজিস্টর, আইসি ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইজ, কিন্তু মানুষের ব্রেইন জীবন্ত জিনিস; যেটা ১০০ বিলিয়নের মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত যাকে নিউরন বলা হয়, প্রত্যেকটি স্নায়ু কোষ একে অপরের সাথে ডেনড্রাইটস (Dendrites) এবং আক্সন (Axon) দ্বারা কানেক্টেড থাকে।
এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, কম্পিউটার এবং ব্রেইন সম্পূর্ণ আলাদা গঠনের জিনিস। কিন্তু ব্রেইনের কাজ করার ধরণ অনেকটা কম্পিউটারের মতোই। আমরা যখন কথা বলি, কাজ করি, ভাবি, বা যেকোনো কিছু করি —সেটাকে সম্পূর্ণ করার জন্য নিউরন কাজ করে। আর এই কাজ করার সময় নিউরন এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল তৈরি করে এবং সেটা নিউরন থেকে নিউরনে শেয়ার হয়। আর আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, ইলেকট্রনিক্সও ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর কাজ করে। এই ইলেকট্রিক সিগন্যালের উপর ভিত্তি করেই ব্রেইনকে কম্পিউটারের সাথে বা কম্পিউটারকে ব্রেইনের সাথে কানেক্টেড করা সম্ভব। আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মাইন্ড আপলোডিং প্রযুক্তি এই ধারণার উপরই কাজ করে।
যাই হোক, মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া ইলেকট্রিক সিগন্যাল বিজ্ঞানীরা রীড করতে সক্ষম, অর্থাৎ বিভিন্ন কাজ করার সময় আমাদের ব্রেইনের মধ্যে যে বিভিন্ন প্রকারের সিগন্যাল তৈরি হয়, বিজ্ঞানীরা সেই সিগন্যালকে ধরতে পারে এবং কোনটি কোন কাজের জন্য উৎপাদিত হয় সেটা বুঝতে পারে। যেমন ধরুন আপনি চোখের সামনে লাল বা সবুজ রঙ দেখছেন, এখন আপনার চোখ থেকে অপটিক স্নায়ু এক ধরনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল ব্রেইনের কাছে পাঠিয়ে দেবে।
আর ঐ সিগন্যালের মধ্যে তথ্য জিপ করা থাকে, আপনার চোখ ঠিক কোন রঙটি দেখেছে। এখন আপনি যদি ঐ সিগন্যালটি রীড করতে পারেন এবং একই সিগন্যাল ক্যামেরা থেকে নিয়ে সরাসরি মস্তিষ্কে সেন্ড করতে পারেন, তবে আপনার মস্তিষ্ক একই রঙ দেখতে পাবে, এভাবে ক্যামেরার সাহায্যে সিগন্যাল তৈরি করে অন্ধ মানুষকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। কেনোনা অন্ধদের চোখ যতোই নষ্ট হয়ে যাক না কেন, তাদের মস্তিষ্কের সিগন্যাল চেনার ক্ষমতা কিন্তু নষ্ট হয় না।
ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস।
বিসিআই ইনপুট/আউটপুট।
এই প্রযুক্তিকে ঠিকঠাক মতো কাজ করানোর বেসিক আইডিয়াই এর গবেষকদের অনেক ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে, কেনোনা আমাদের ব্রেইন এতোটা সহজ জিনিস নয়, এতে কোটিকোটি নিউরন রয়েছে এবং কোটিকোটি সিগন্যাল জেনারেট করছে সর্বদা।
মানুষের ব্রেইন সবচাইতে কমপ্লেক্স পদ্ধতি’তে কাজ করে। ব্রেইন থেকে সিগন্যাল রীড করার জন্য অবশ্যই মাথায় কিছু লাগানোর প্রয়োজন পড়বে যেটা সিগন্যাল গুলোকে ক্যাপচার করে কম্পিউটারে পাঠাবে। এই কাজের জন্য ইলেক্ট্রোড (Electrodes) ব্যবহার করা হয়, যেটার ডিভাইজের নাম ইলেক্ট্রোএনসেফ্যালোগ্রাফ (Electroencephalograph); আর একে মাথার ত্বকের সাথে লাগিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ইলেক্ট্রোড মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক সিগন্যাল গুলো পড়তে পারে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে অনেক ক্ষীণ সিগন্যাল আসে এবং বেশিরভাগ সিগন্যাল মাথার খুলী’ই আটকিয়ে দেয়।
তাই বেটার সিগন্যাল কোয়ালিটি পাওয়ার জন্য গবেষকরা মাথার খুলী ফাটিয়ে সরাসরি ঘিলুর উপরে ইলেক্ট্রোড প্ল্যান্ট করিয়ে দেয়। মাথার মগজের উপরে ইলেক্ট্রোড প্ল্যান্ট করার রিয়াল ছবি দেখতে এখানে → (চিত্র-১ | চিত্র-২) ক্লিক করুণ।
বিঃদ্রঃ ছবি গুলো দুর্বল হৃদয়ের মানুষের না দেখার জন্য রেকোমেন্ড করবো।
সরাসরি ব্রেইনের সার্ফেসে ইলেক্ট্রোড ইন্সটল করার ফলে আগের তুলনায় অনেক ভালো সিগন্যাল কোয়ালিটি পাওয়া যায়।
যাই হোক, মাথার খুলী ফাটিয়ে ঘিলুর একদম উপরের তলায় ইলেক্ট্রোড লাগানো চারটি খানি কথা নয়, এতে বিশাল সার্জারির প্রয়োজন হয়। একবার সফলভাবে সার্জারি করে প্ল্যান্ট করা সম্ভব হলে তারপরে ইলেক্ট্রোড মস্তিষ্ক থেকে ইলেকট্রিক সিগন্যাল ক্যাপচার করতে আরম্ভ করে, যেহেতু সিগন্যাল গুলো খুবই দুর্বল তাই ঠিকঠাক মতো কাজ করার জন্য সিগন্যাল গুলোকে ফিল্টার এবং এমপ্লিফাই করা হয়। একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই ইলেকট্রিক সিগন্যাল গুলোর প্যাটার্ন গুলোকে সেভ করে রাখা হয়, এই সিগন্যাল প্যাটার্ন গুলো দেখতে অডিও ওয়েভ ফর্মের মতোই।
প্রথমে কোন কাজের জন্য মস্তিষ্কে কি ধরনের সিগন্যাল তৈরি হয় সেটা রীড করা হয় এবং পরে কম্পিউটারে থাকা বিসিআই প্রোগ্রাম থেকে হুবহু রিভার্স সিগন্যাল তৈরি করে মস্তিকের নিউরনে প্ল্যান্ট করে দেওয়া হয়। ধরুন আপনার চোখ কিছু সাবজেক্ট দেখছে, এতে নিশ্চয় এক ধরনের সিগন্যাল মস্তিষ্কের কাছে পৌঁছাচ্ছে, সেই সিগন্যালের প্যাটার্ন বুঝে যদি ক্যামেরা থেকে ছবি নেওয়ার পরে একই সিগন্যাল তৈরি করে নিউরনে প্ল্যান্ট করা যায়, তবে অবশ্যই মস্তিষ্ক সেটা দেখতে পারবে, মস্তিষ্কে ভিজুয়াল ইমেজ তৈরি হবে।
অ্যাপ্লিকেশন।
তাছাড়া মস্তিষ্কের মধ্যে কোন সাবজেক্ট মুভ করানোর চিন্তা করে কম্পিউটার কার্সর সরানোরা করানোও সম্ভব হবে, সবকিছুই হয়ে যাবে মাইন্ড কন্ট্রোল। তাছাড়া আরো বিশদভাবে মস্তিষ্ক পড়া সম্ভব হলে হয়তো মাইন্ড ব্যবহার করে কোন কিছু টাইপও করা যাবে, তাছাড়া কিছু না করেই টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করার সুবিধা তো থাকবেই। উল্লেখ্য এই যে, একবার সকল প্রসেস গুলো যদি ঠিকঠাক মতো করানো যায়, তবে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস নিয়ে সম্ভবনার কোন সীমা থাকবে না।
বিসিআই থেকে আমরা কতো দূরে?
দেখুন আমাদের মস্তিষ্ক এতোটা সহজ ব্যাপার নয়, পৃথিবীর যেকোনো কমপ্লেক্স মেশিনের চাইতেও বেশি কমপ্লেক্স আমাদের মস্তিষ্ক; এতে কোটি কোটি নিউরন রয়েছে যেগুলো লাগাতার একে অপরের সাথে ইলেক্ট্রিক সিগন্যাল সেন্ড ও রিসিভ করছে, আর ইলেক্ট্রোড এতো সূক্ষ্ম করে সিগন্যাল ক্যাপচার করতে এখনো সক্ষম হয় নি। তাছাড়া মস্তিষ্কে শুধু ইলেকট্রিক সিগন্যালই নয় বরং সেখানে কেমিক্যাল ব্যাপার সাপারও ঘটে আর যেটা ইলেক্ট্রোড দ্বারা ক্যাপচার করা সম্ভব নয়।
তাছাড়া মস্তিষ্ক থেকে অনেক ক্ষীণ সিগন্যাল আসে যেটা ক্যাপচার করা অনেকটা মাছের বাজারে দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে কারো সাথে গল্প করার ন্যায়। আর সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস এ এখনো তারের ব্যবহার করা হয়, সাথে কম্পিউটার গুলোর সাইজ দৈত্যাকার, যদি পোর্টেবল আর ওয়্যারলেস প্রযুক্তিকে এখানে সামিল করানো যায়, তবেই এই প্রযুক্তির বিস্তার লাভ করবে। তবে আমি নিশ্চিত, আমরা পারবোই।
শেষ কথা।
যেখানে এতো অসাধারণ কিছু নিয়ে আলোচনা, সেটার ইতি টানতেই ইচ্ছা করে না। তারপরেও শেষ করতে হচ্ছে কেনোনা এমনিতেই আর্টিকেল অনেক লম্বা হয়ে গেছে। তো আপনি কি মনে করেন, এরকম অসাধারণ প্রযুক্তি সম্পর্কে? —কি কি সম্ভবনা রয়েছে? একে কি আদৌ উন্নতি করানো যাবে? —সবকিছু আমাদের নিচে কমেন্ট করে জানান। তাহলে আজকে এই পর্যন্ত অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে পোস্টটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য।
আশা করি আজকের এই পোস্ট টি সবারই অনেক উপকারে আসবে। সবাই ভাল থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, নিরাপদ থাকবেন Sobuz Bangla TV এর সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।
কোন মন্তব্য নেই